অনুবাদ: সারোয়ার তুষার
অনুবাদকের ভূমিকা: বাঙ্গালি বংশোদ্ভূত ইণ্ডিয়ান চিন্তক ও Centre for the Study of Developing Societies (CSDS) এর সম্মানিত ফেলো আদিত্য নিগাম গত ২৬ মার্চ, ২০২০ এ Kaflia.online এ Corona Biopolitcs and Life After Capitalism-A Manifesto of Hope (করোনা জৈব-রাজনীতি ও পুঁজিবাদের পরের জীবন: আশার ইশতেহার) শীর্ষক একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন। এই প্রবন্ধে তিনি বিশ্বপরিসরে করোনা মহামারিকে কেন্দ্র করে যে সমস্ত আলাপ-আলোচনা-তর্ক উঠেছে, সেগুলোর পুনর্মূল্যায়ন করার মাধ্যমে পুঁজিবাদ-উত্তর সমাজের সম্ভাব্য রূপরেখার ইঙ্গিত করার চেষ্টা করেছেন। ভারত, বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের বাস্তবতায় আদিত্য নিগামের প্রবন্ধটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
আদিত্য নিগাম মূলত সামাজিক-রাজনৈতিক তত্ত্বের বিউপনিবেশায়নে (decolonization) বিশেষভাবে আগ্রহী। এই প্রবন্ধেও আমরা দেখব তিনি পুঁজির ধারণার পুনর্মূল্যায়ন করেছেন। পুঁজি বিশ্লেষণের সনাতনি ঐতিহাসিক ভ্রান্তিই যে বিগত শতকগুলোর সমস্ত সামাজিক বিপ্লবকে মহাদানবীয় সর্বাত্মকবাদী রাষ্ট্রীয় গাড্ডায় নিক্ষেপ করেছে আদিত্য নিগাম তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন।
পশ্চিমের বাস্তবতায় স্বল্প ও মধ্যমেয়াদে জনবান্ধব প্রকল্পগুলোর দাবিকে পশ্চিমের বাইরের বিশাল দুনিয়ার (অরিয়েন্টালি ‘তৃতীয় বিশ্ব’) আর্থ-সামাজিক বাস্তবতায় পরখ করছেন এবং সঙ্গত প্রশ্ন তুলছেন।
এই প্রবন্ধে তিনি একাধিকবার ফ্যাশন তাত্ত্বিক লি এডেলকুর্টের উদ্ধৃতি ব্যবহার করেছেন। ‘ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস’ ফ্যাশন ওয়ার্ল্ডের একজন ইনসাইডার হিশেবে এডেলকুর্টের ‘slow life’ এর উপলব্ধি তাৎপর্যপুর্ণ তো বটেই! কিন্তু এই ‘slow life’ এর অর্থ কোনভাবেই প্রাচিন যুগে ফিরে যাওয়া কিংবা কৃচ্ছতাবাদী জীবনের বাসনা নয়। বরং, পণ্য ভোগের নামে ক্রমাগত পুঁজির ধর্ষণ ‘উপভোগ’ করার যে জীবন; যা মানুষকে পরিণত করে ভোক্তায়, সমাজকে পরিণত করে বাজারে, সেই নিওলিবারেল পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ব্যক্তি ও সমাজের আত্মকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সক্রিয়তাই এডেলকুর্ট কথিত ‘slow‘life’। জীবনানন্দ দাশ সেই কবেই লিখে গেছেন:
আমি অতো তাড়াতাড়ি কোথাও যেতে চাইনা;
আমার জীবন যা চায় সেখানে হেঁটে হেঁটে পৌঁছুবার সময় আছে,
পৌঁছে অনেকক্ষণ বসে অপেক্ষা করবার অবসর আছে।
জীবনানন্দ দাশের আকুতিকে ‘কবির ভাবালুতা’ বলে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ ছিল, কিন্তু এডেলকুর্টের মতো কর্পোরেট দুনিয়ার আইকনদের একই আকুতিকে অস্বীকার করাটা বোধহয় আর সহজ হবে না।
করোনা মহামারির ফলে একটা ভিন্ন সমাজের বিমূর্ত স্বপ্ন আরো প্রবলভাবে মূর্ত হয়ে উঠছে বলে মনে করেন আদিত্য নিগাম। এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ইতিহাসচেতনা-চিন্তাচর্চা ও সক্রিয়তাই কেবল পারে পৃথিবীতে মানুষের সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে।
এই ধরনের ইতিহাস ও চিন্তা চর্চা পৃথিবীর উপর মানুষের সার্বভৌমত্ব /উপনিবেশ নাকচ করে দিয়ে মানুষকে বায়োলজিকাল/জিওলজিকাল এজেন্ট হিসেবে প্রপোজ করে। মানুষও আর দশটা স্পিসিসের মত স্পিসিস। অধীশ্বর নয়। মানুষের ইতিহাস মানে মানুষের ‘নায়ক’ হবার ইতিহাস না, অন্তত ‘recorded history’ যেভাবে দেখাতে চায়; বরং ‘deep history’ অনুযায়ী মানুষের ইতিহাস আসলে ‘জীবনের ইতিহাস’ এর অংশ, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি পরস্পরের সহযোগিতা ও প্রতিযোগিতা, দুই সম্পর্কেই আবদ্ধ। (দীপেশ / ২০১৬)
এরকম একটা সামাজিক রূপান্তর সম্ভব বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থার রূপান্তরের মাধ্যমেই। আদিত্য নিগামের প্রকাশিতব্য দ্বিতীয় প্রবন্ধে তিনি পুঁজিবাদ-উত্তর সমাজব্যবস্থার অর্থনৈতিক রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করবেন। আমরা সেই প্রবন্ধটিরও অনুবাদ হাজির করার চেষ্টা করব।
করোনা জৈব-রাজনীতি ও পুঁজিবাদের পরের জীবন: আশার ইশতেহার
মনে হচ্ছে যেন আমরা ব্যাপকভাবে ভোগের কোয়ারেন্টিনে ঢুকে পড়েছি যেখানে জীবনকে সুন্দর করার জন্য আমরা খুব অল্পেই তুষ্ট থাকব— একটি অতি সাধারণ জামা, নিজেদের পুরোনো পছন্দের বিষয়গুলো পুনরায় আবিষ্কার করা, বিস্মৃত কোন বই পড়া এবং তুমুল আড্ডাবাজিতে লিপ্ত হওয়া। একটা বিকল্প ও গভীরভাবে ভিন্ন দুনিয়া গড়ে তুলতে ভাইরাসের প্রভাব হবে সাংস্কৃতিক ও গুরুত্বপূর্ণ।
– লি এডেলকুর্ট, ট্রেন্ডফোর কাস্টার এবং ফ্যাশন উপদেষ্টা
যখন বিশ্বের বেশিরভাগ অঞ্চলের মানুষ লকডাউনের পাঁকচক্রে পড়ে বিশ শতকের গোড়ার দিককার স্প্যানিশ ফ্লু, এমনকি চতুর্দশ শতাব্দীর প্লেগের স্মৃতি স্মরণ করছে; আমার চিন্তাভাবনা তখন আসলে অন্যখাতে প্রবাহিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় বিমান চলাচল সর্বনিম্নতম পর্যায়ে নেমে যাওয়ার সাথে সাথে, স্পষ্টতই ব্যয়বহুল খরচাদি বন্ধ হয়ে যাওয়া, রাস্তাগুলোতে লক্ষ লক্ষ গাড়ি এবং নির্মাণ কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ার বাস্তবতায় আমি আচমকাই এক অতিসাধারণ চিন্তায় আক্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম: এরকম একটা লকডাউন জনগোষ্ঠীর সবচাইতে দরিদ্র অংশের জন্য আবশ্যিকভাবে যে দুঃখকষ্ট বয়ে আনে, তার দুর্ভোগের মেঘের আড়ালে সম্ভাবনার সূর্য উঁকিও দিতে পারে। আমরা যখন এই সংকটটি কাটিয়ে উঠব, খুব সম্ভবত তখন পৃথিবীর তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি নেমে আসবে এবং এর চেয়েও বেশি যা হতে পারে, সম্ভবত পৃথিবীতে অস্তিত্বের এক ভিন্ন রূপের সূচনা হতে পারে। এটি বিশ্বকে সেটাই দেখার সুযোগ করে দিতে পারে যা এ যাবৎকাল জলবায়ু সংকট অস্বীকারকারীরা প্রত্যাখান করে এসেছিল (নাওমি ক্লেইন যেমনটি দেখিয়েছেন, জলবায়ুকে অস্বীকার করার এই রাজনীতি মার্কিন ডানপন্থি ফাউন্ডেশন এবং কর্পোরেশনগুলোর বিশাল তহবিল দ্বারা সমর্থিত)। এটা হয়তো আমরা যা পেছনে ফেলে এসেছি এবং আমরা গভীরভাবে যার প্রতীক্ষায় আছি— জীবনের এক ভিন্ন গতি (ধীরতা যেখানে সুন্দর)— তার সাথে আমাদের বিচ্ছিন্ন সংযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে।
সে যাই হোক, কর্পোরেট সেক্টরে ছিলেন এমন অনেককেই আমি জানি, যারা নিওলিবারেল কালপর্বে জটিল জীবনযাপনের সমস্ত কিছুই নিলামে তোলার ইঁদুরদৌড় খাপ খাওয়াতে না পেরে কর্পোরেট দুনিয়া থেকে বের হয়ে এসেছেন। তারাই একসময় ‘সাহসী ও সুন্দর’ এর এই জীবন বিপুল উৎসাহে বেছে নিয়েছিলেন— যেখানে আপনি কোনও আন্তর্জাতিক ফ্লাইটেই থাকুন আর অবকাশ যাপনের জন্য সমুদ্রবিলাসেই থাকুন না কেন, আপনাকে অবশ্যই নিজের ল্যাপটপে মনোযোগ রাখতে হবে। আমি এমন অনেক লোককে জানি যারা জীবনকে পুনরায় খুঁজে পেতে গত কয়েক দশকে তাদের নিশ্চিত স্বাচ্ছন্দ্যের কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। নিওলিবারেল যুগ আমাদেরকে অতিক্রম করে যাওয়ার সাথে সাথে, গতির সাথে আধুনিকতার দহরমমহরমও দ্রুত শেষ হতে চলেছে। করোনা ভাইরাস কেবল সেই পরিণতিই আমাদের সামনে মঞ্চস্থ করে চলেছে। এই লেখার শুরুতেই ‘ভোগের কোয়ারেন্টিন’ এবং এর সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবগুলোকে নির্দেশ করা উদ্ধৃতিটি কৃচ্ছতাবাদী কোনও গান্ধীবাদী তপস্বী কিংবা পুনরায় প্রাণ ফিরে পাওয়া কোন বামপন্থি অ্যাক্টিভিস্ট-বুদ্ধিজীবীর নয়; বরং ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির একেবারে প্রাণকেন্দ্রে বেঁচে থাকা এবং কাজ করা কারোর উদ্ধৃতি।
জৈব রাজনৈতিক [১] কলকব্জা
‘পুঁজিবাদের পরের জীবন’ প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে, এই বিষয়ে জোর দেয়া জরুরি যে, জৈবরাজনৈতিক কল্পনা থেকে আমরা যদি মুক্ত হতে না পারি তাহলে খুব সম্ভবত করোনা ভাইরাস মোকাবেলার নামে আমরা এক ভয়ঙ্ককর পরিস্থিতিতে পদার্পণ করতে যাচ্ছি। নতুন প্রযুক্তির জৈবরাজনৈতিক বিভীষিকার যে উন্মোচন মিশেল ফুকোর মারাত্মক দুঃস্বপ্ন ছিল, সেই বিভীষিকারই আরো বিস্তৃত রূপ সঙ্গতকারণেই আমাদেরকে আতঙ্কিত করা উচিত। এর কিছু কিছু সম্প্রতি ইজরায়েলের ইতিহাসবিদ ইউভাল নোয়াহ হারারি তুলে ধরেছেন।
ফুকোর বায়োপলিটিকস হলো খোদ জীবনকেই সরকারি ক্ষমতার বস্তুতে পরিণত করা। মৃত্যুহার হ্রাস, প্রত্যাশিত আয়ু বাড়ানোসহ এমন মেলা অপেক্ষাকৃত ‘মঙ্গলজনক’ কর্মসূচির মাধ্যমে এর শুরু হয়। এই প্রাথমিক ‘মঙ্গলজনক’ নাক গলানোই অবশেষে মানুষের জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে আধুনিক সরকারি হস্তক্ষেপের অনুমোদন এবং নৈতিক ন্যায্যতা দিয়েছে। আধুনিক ক্ষমতাতন্ত্র মানুষের জীবনের এত গভীরে পৌঁছাতে পারে যা পুরোনা সাম্রাজ্য ও সার্বভৌম রাজাদের পক্ষে কল্পনা করাও অসম্ভব ছিল। সর্বাত্মক নজরদারি রাষ্ট্রগুলো কর্তৃক ক্ষমতাকে ক্রমাগত কেন্দ্রীভূত করার প্রবণতা তখন থেকেই ভয়াবহভাবে বেড়েছে এবং আমরা ভারতেও সেই হতবুদ্ধিকর নিরঙ্কুশ ক্ষমতাবৃদ্ধির ট্র্যাজি-কমিক ( নাকি পরাবাস্তব?) সংস্করণ প্রত্যক্ষ করছি। ফিনান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত হারারির উল্লেখিত প্রবন্ধে তিনি যেমনটি বলেছেন, করোনা ভাইরাস মহামারি মোকাবেলার ক্ষেত্রে চীনের মতো অনেক রাষ্ট্রের সরকারই নজরদারির নিত্যনতুন প্রযুক্তি নজিরবিহীন কায়দায় ব্যবহার করছে:
জনসাধারণের স্মার্টফোনগুলোকে নিবিড় তত্ত্বাবধানের আওতায় এনে, লক্ষ লক্ষ চেহারা-শনাক্তকরণ ক্যামেরা ব্যবহার করে, এবং জনসাধারণকে তাদের দৈহিক তাপমাত্রা ও স্বাস্থ্য পরিস্থিতি চেক করতে এবং এই বিষয়ক প্রতিবেদন দাখিল করতে বাধ্য করে, চীনা কর্তৃপক্ষ শুধু যে দ্রুততার সাথে সন্দেহভাজন করোনাভাইরাস বাহকদেরকে শনাক্ত করতে পেরেছে তাই নয়, তাদের গতিবিধিও ট্র্যাক করতে পেরেছে, এবং তাদের সংস্পর্শে আসা যে কাউকে চিহ্নিত করতে পেরেছে। নাগরিকদেরকে সংক্রমিত রোগীদের সাথে তাদের ঘনিষ্ঠতার ব্যাপারে একগুচ্ছ মোবাইল অ্যাপস সতর্ক করে দেয়।
আমি এখানে এই বিষয়টিকে বিশেষভাবে তুলে ধরতে চাই কারণ আধুনিক রাষ্ট্র এবং শাসনপ্রণালী নিজেই জৈবরাজনৈতিক কলকব্জা গঠন করে; এই গঠনপ্রক্রিয়া কেবলই মূলধন আর পুঁজিবাদের একচেটিয়া মামলা নয়। একটা রাষ্ট্র প্রবণতার দিক থেকে বামপন্থি বা সমাজতান্ত্রিক কিনা এতে আদৌ কিছু এসে যায় না এবং বিশ শতকের সমাজতান্ত্রিক রেজিমগুলো সর্বাত্মকবাদী (নাগরিকদের জীবন নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে) হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল এই রেজিমগুলো বাছবিচার ছাড়াই জৈবরাজনৈতিক কলকব্জায় পরিণত হয়েছিল। আমি এখানে এই বিষয়টি ঊর্ধে তুলে ধরতে চাই কারণ আমাদের সমসাময়িক অনেক চিন্তাভাবনাই রাষ্ট্রকাঠামোর বাইরে চিন্তা করতে অপারগ বলে মনে হচ্ছে এবং পুঁজিবাদের পরের জীবন সম্পর্কে গুরুত্ব সহকারে ভাবতে গেলে আমাদের অবশ্যই রাষ্ট্রকাঠামোর বাইরে ভাবতে পারতে হবে।
যাইহোক, এই মুহুর্তে, এই লেখাটিতে আমার ঝোঁক শেষপরিণতির চিত্র ভাবার দিকে নয় কারণ আজকাল এ নিয়ে মেলা ভাবনাচিন্তা হচ্ছে। কোভিড-১৯ এর এই কালে হতাশার অনুভূতি সর্বজনীন প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। আর ইতোমধ্যেই বিরাজমান হতাশাজনক পরিস্থিতির কারণে আমাদের ভারতে এই প্রবণতা আরো তীব্র হয়েছে। একটা বৈশ্বিক মহামারির মোকাবেলা অপরাপর যে সকল দুর্যোগের দিকে ঠেলে দিতে পারে, সেই সকল দুর্যোগের আলামতও ইতোমধ্যেই লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
এর মধ্যে আরও আছে নাওমি ক্লেইনের পূর্বাভাস, ট্রাম্প ও তার মোসাহেবগোষ্ঠী জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মূলত দায়ী কর্পোরেশনগুলোকেই বিশেষ আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। ক্লেইন পুঁজিবাদ, বিশেষত ‘দুর্যোগ পুঁজিবাদ’ কীভাবে প্রতিটি শক (Shock), প্রতিটি বিপর্যয়কে আরও বেশি অর্থোপার্জন ও মুনাফা কামানোর সুযোগে রূপান্তরিত করে সে সম্পর্কে তাঁর যুক্তি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। [হতাশাজনক পরিস্থিতি সম্পর্কে The Intercept এ প্রকাশিত ক্লেইনের ভিডিও বার্তার শ্রুতিলিখনের অনুবাদ ও একই বিষয়ে The Vice এ প্রকাশিত ক্লেইনের একটি সাক্ষাতকারের অনুবাদ এখানে হাজির করা হলো— অনুবাদক]
রূপান্তরশীল পুঁজিবাদ
আমি অবশ্যই হারারি এবং ক্লেইন উভয়ের সাথেই একমত। যদিও ক্লেইনের ভিডিওর দ্বিতীয় অংশটি প্রকৃতপক্ষে আশার কথা বলেছে যেহেতু তিনি সঙ্কটটিকে স্বাস্থ্যসেবা বহুমুখিকরণের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের ক্ষেত্র হিসেবেও দেখতে চাইছেন। আসন্ন মার্কিন নির্বাচনের ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি ‘গ্রিন নিউ ডিল’[২] এর দাবিকে জোরালো করতে এই সংকটের পরিস্থিতিকে কাজে লাগানোর গুরুত্বের কথাও বলছেন— আসলে একই কথা অন্য আরো অনেকে দীর্ঘদিন ধরে বলে যাচ্ছেন। সংকটের প্রতিক্রিয়ায় সরকারগুলো যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে, অনেক পণ্ডিত ও বিশ্লেষকই ভাবতে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন যে এর ফলে বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদ ও অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনায় একটি পরিবর্তন ঘটতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, দ্য গার্ডিয়ান– এ লিখিত প্রবন্ধে পণ্ডিত এবং বিশ্লেষক উইলিয়াম ডেভিস পরামর্শ দিয়েছেন যে এটি সম্ভবত ‘বিশ্বজগতের ঘটনা’ হয়ে উঠবে যা ‘নতুন অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সূচনা’র দ্বার উন্মোচন করবে।’ ডেভিস এখনও এই নতুন সূচনাটিকে বৈশ্বিক পুঁজিবাদের মধ্যে এক ধরনের রূপান্তরের আগাম ঘোষণা হিসেবে দেখেন। তবে, এখানে আমার মনোযোগ অন্যদিকে কারণ স্বল্প ও মধ্যমেয়াদে সিস্টেমের কাছ থেকে আমরা যা কিছু আদায় করতে পারি পুঁজিবাদ-উত্তর ভবিষ্যতের সম্ভাবনা তাকে ছাপিয়ে আরো বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। স্বল্প ও মধ্য মেয়াদে, আমাদের অবশ্যই সাধ্যের সবটুকু অর্জন করতে হবে— গ্রিন নিউ ডিল, সাময়িক সর্বজনীন ন্যূনতম আয় (Universal basic income-UBI), এবং স্পেনের মতো স্বাস্থ্যসেবার সাময়িক জাতীয়করণও হতে পারে। আসল ব্যাপার হলো অনেক সরকার— এমনকি ইংল্যান্ডের বরিস জনসনের এবং যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্পের মতো ডানপন্থি সরকারগুলোকেও সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করতে হচ্ছে। ব্রিটিশ সরকার ইতোমধ্যেই ঘোষণা করেছে যে কোম্পানিগুলোর বেতনভুক্ত শ্রমিকদের ৮০ শতাংশকেই সরকার বেতনভর্তুকির আওতাভুক্ত করবে (উপরের লিঙ্কে ডেভিসের নিবন্ধটি দেখুন) ।কিছুদিন আগ পর্যন্ত সরকারের তরফ থেকে এমন কোন সিদ্ধান্তের ঘোষণা অভূতপূর্ব ও কল্পনাতীত ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, একটি নির্দিষ্ট আয়সীমার নীচে অবস্থিত সমস্ত প্রাপ্তবয়স্কদের সর্বজনীন ন্যূনতম আয় গোছের নগদ অর্থ বিতরণের বিষয়টি গুরুতর আলোচনার মধ্যে রয়েছে। টাইম ম্যাগাজিনে অ্যাবি ভ্যাসলিসের টাইম ম্যাগাজিনে অ্যাবি ভ্যাসলিসের ( Abby Vesoulis) পর্যবেক্ষণ :
স্যান ডিয়েগো’র সেন্টার ফর এথিক্স, ইকোনমিক্স এবং পাবলিক পলিসির পরিচালক ম্যাট যোলিন্সকি (Matt Zwolinski) বলেছেন, ‘একজন রিপাবলিকানের ২০২০ সালে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সরাসরি নগদ অর্থ প্রদানের আহবান জানানো এই ইঙ্গিত দেয় যে ইউবিআই(UBI) জনপ্রিয় হচ্ছে। তিনি আরো বলেন, ‘ডানপন্থি কোন রাজনীতিবিদের এরকম কিছু সমর্থন করাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ ; একটি নির্দিষ্ট বলয়ে, যারা অন্যসময়ে এই দাবি ও উদ্যোগকে এক ধরনের ‘সমাজতন্ত্র’ হিশেবে দেখতেন, তাদের মধ্যে এই প্রকল্পের ন্যায্যতা সৃষ্টি করতে এটি বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
আমার মতে, এই জাতীয় নীতিমালা ও ব্যবস্থাকে, (যদিও তারা স্বল্প-মেয়াদী ব্যবস্থা হতে পারে), অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনার সাথে নতুন প্রবণতা হিশেবে গাঁটছড়া বাঁধার সম্ভাবনা আছে। সর্বজনীন ন্যূনতম আয় এমন একটি উদাহরণ। এইসব নীতিমালা মধ্যমেয়াদে অধিকতর মৌলিক পুনর্বিবেচনার দিকে ধাবিত করতে পারার মত প্রশ্ন হাজির করতে পারে, যেমনটি এতদিন ধরে করে এসেছে পরিবেশবাদী অর্থনীতির বিভিন্ন ঘরানা এবং আরো সুনির্দিষ্টভাবে বললে প্রবৃদ্ধি-বিরোধি/ প্রবৃদ্ধি-উত্তর আন্দোলন (এ সম্পর্কে Kafila তে আমরা আগেও লিখেছি)। এই সমস্ত কর্মপরিকল্পনা পুঁজিবাদের রূপান্তর না ঘটিয়ে পারেই না— এমন রূপান্তর যা পুঁজিবাদী শোষণের পাটাতনকে অক্ষত রেখে টুকিটাকি পরিবর্তনের চর্চাকে বহুদূর পর্যন্ত ছাপিয়ে যাবে।
পুঁজিবাদের পরের জীবন
আমি এখানে যে পরিবর্তনগুলোর কথা বলছি তার মধ্যে অন্য কিছু ব্যাপার আছে যা আমলে নেয়া দরকার। এটি দীর্ঘকালীন দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন যা বেশ কিছুকাল ধরেই ঘটে চলেছে তবে বর্তমান সংকটের প্রবল ঝাঁকুনি এই পরিবর্তনগুলোকে আরো তীব্রতার সাথে অবশ্যসম্ভাবী করে তুলছে। মার্কসবাদীরা এখনও মনে করেন ‘বৈপ্লবিক’ উপায়ে ক্ষমতা দখলের মাধ্যমেই কেবল পুঁজিবাদের চূড়ান্ত রূপান্তর সম্ভব। এবং কোন না কোনভাবে ভোগকে ছেঁটে ফেলে বা প্রযুক্তিকে প্রশ্ন করে এমন যেকোনও পরিবর্তনকে তারা ‘পশ্চাৎগামিতা’ মনে করে। তাদের ‘ধর্মীয়’ শাস্ত্র অনুযায়ী পুঁজিবাদকে কেবল ‘আরও অগ্রসর’ (আজকের দুনিয়ায় এর যা যা মানে হওয়া সম্ভব) কোনকিছু দ্বারাই ছাপিয়ে যাওয়া সম্ভব। একটি সাদামাটা নজির হিশেবে, আমি আরও একবার এই লেখার শুরুতে উদ্ধৃত লি এডেলকুর্টের সাক্ষাতকারটির প্রসঙ্গ টানতে চাই। আমি যখন প্রথমে আমার মার্ক্সবাদী বন্ধুদের সাথে এডেলকুর্টের সাক্ষাতকারটি শেয়ার করলাম, তারা তার সমস্ত কথাকেই ‘ভোগের কোয়ারেন্টিন’, ‘পিছিয়ে পড়া’ হিশেবে বিবেচনা করে এক কথায় বাতিলই করে দিল। তারা ধরেই নিয়েছিল কোন গান্ধীবাদী মেজাজের তপস্বীর কাছ থেকে কথাগুলো আসছে। আমার ঘোরতর সন্দেহ এডেলকুর্ট ব্যক্তি হিশেবে কে এটা খুঁজে বার করার মত ধৈর্যও আমার এই মার্ক্সবাদী বন্ধুদের ছিল না। তার ব্যাপারে আমার কাছে সবচেয়ে যেটা চমকপ্রদ লেগেছে সেটি হলো তিনি কর্পোরেট দুনিয়া— আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে ফ্যাশন ও ডিজাইন জগতের প্রাণকেন্দ্রের মানুষ—ফলে তার বক্তব্য কোন ক্ষ্যাপাটে গান্ধীবাদী কিংবা ‘বিকারগ্রস্ত পরিবেশবাদী’র বক্তব্য বলে উড়িয়ে দেয়ার সুযোগ নেই। আমার বদ্ধমূল ধারণা, তার এই অবস্থান আমার পূর্বেই উল্লেখিত প্রবণতার সাথে জড়িত, কর্পোরেট দুনিয়ার বহু মানুষ সেই দুনিয়া থেকে বের হয়ে জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তুলতে চাইছে স্কুল চালানো থেকে শুরু করে জৈব কৃষি সহ অন্য অনেক কাজের মাধ্যমে।
এই প্রবণতা আমাদেরকে কোন পুঁজিবাদ-উত্তর ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে কি যাবেনা, তা অন্য অনেক কিছুর সাথে নির্ভর করছে আমাদের ভিশন ও পুঁজিবাদ সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়া পুনর্বিবেচনার মধ্যে।
প্রথমত, রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রের পতনের কারণ অন্বেষণের কোন গভীর বিশ্লেষণ বা ব্যাখ্যার অনুপস্থিতিতে, ‘বিপ্লবী রাষ্ট্রক্ষমতার দখল’ সমাজতন্ত্রের দিকে ধাবিত করবে বা পুঁজিবাদের রূপান্তর ঘটাবে এমনটা বিশ্বাস করার কোন কারণই নেই। অন্যদিকে, যদি কেউ যুক্তি দেয় যে নানাবিধ কারণে পুঁজিবাদ আগাগোড়া (যেমন সভ্যতার পূর্বশর্ত হিশেবে ‘সম্পদ তৈরি’-করের মাধ্যমে রাজস্ব উৎপাদন যা কেবলমাত্র ব্যক্তিগত সম্পত্তি তৈরির মাধ্যমেই সম্ভব), পূর্বেও এবং এখনো, আধুনিক রাষ্ট্রের প্রকল্প; তাহলে আমাদের কাছে পরিস্কার হয় কেন বিপ্লব পরবর্তী প্রতিটি রাষ্ট্রই পুঁজিবাদে পর্যবসিত হয় কিংবা সংকটে পতিত হয়। অবশ্য, পণ্য উৎপাদন, বাজার সম্পর্ক, বাণিজ্য এবং শিল্পোদ্যোগ মাত্রই তা পুঁজিবাদের লক্ষণ বা অনিবার্যভাবে পুঁজিবাদের দিকে পরিচালিত করে এমন বিভ্রান্তিকর ধারণাও পুঁজিবাদের রূপান্তর কিংবা পুঁজিবাদ-উত্তর সমাজ গঠনের এক বড় অন্তরায়। এগুলো শত শত বছর ধরে পুঁজিবাদের দিকে যাওয়া ব্যতিরেকেই মান্ধাতার আমল থেকে বিরাজমান ছিল। প্রকৃতপক্ষে, ভারতের মতো দেশগুলোতে এগুলো এখনও অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির একটি বিশাল অংশ জুড়ে আছে যা পুঁজিবাদী নিয়মে চলে না। (বিস্তারিত বোঝার জন্য কল্যাণ স্যানালের ‘প্রয়োজনের অর্থনীতি‘র ধারণার সাথে ‘পুঞ্জিভবনের অর্থনীতি’র পার্থক্য খেয়াল করতে পারেন।) প্রকৃতপক্ষে, উপরের প্রথম বন্ধনীতে নির্দেশিত পার্থক্য যদি কেউ গভীরভাবে লক্ষ্য করে থাকেন, তাহলে তিনি বুঝতে পারবেন ভারত এবং দক্ষিণ বিশ্বের বিরাট অংশে সর্বজনীন ন্যূনতম আয় (UBI) একটি নির্মম ধারণা কারণ তা আগেই সম্পূর্ণ সর্বহারাকরণকে (proletarianization) মেনে নেয়। যেসব সমাজে সম্পত্তির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মালিকনা আছে, সেখানে ইউবিআই (UBI) তাদেরকে কেবলমাত্র রাষ্ট্রের জৈবরাজনৈতিক কলকব্জায় পরিণত করবে। নিজেদের জীবনের উপর তাদের যে ন্যূনতম স্বায়ত্তশাসন ও নিয়ন্ত্রণ আছে, সেটিকে ধ্বংস করবে।
দ্বিতীয়ত, প্রায় ক্ষয়িষ্ণু প্রকৃতির সংকটের মুখে নিরবিচ্ছিন্ন পরিবর্তনের মাধ্যমে পুঁজিবাদকে রূপান্তরে বাধ্য করা সম্ভব নয়— এমনটা মনে করার কোন কারণই নেই। পুঁজিবাদ যেমন সামন্ততন্ত্রের মতো পুরানো অর্থনীতির রূপান্তর ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আবির্ভূত হয়েছিল ঠিক তেমনই । তবে আমার মাথায় ‘বুর্জোয়া বিপ্লব’ গোছের এমন কোন ‘বিপ্লব’ নেই যা সামন্ততন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে পুঁজিবাদ নিশ্চিত করেছিল। পল ম্যাসন খুব সম্প্রতি তাঁর PostCapitalism-A Guide to Our Future বইতে পুঁজিবাদের ‘মিউটেশন’ ও একটি পুঁজিবাদ-উত্তর ভবিষ্যত সমাজের কথা বলেছেন। তবে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যটি হ’লো তিনি দেখান যে, পূর্ববর্তী সমস্ত সংকটগুলোর যাবতীয় পরিবর্তন পুঁজিবাদকে পুঁজিবাদেই অপরিবর্তিত রাখে। বর্তমান ডিজিটাল প্রযুক্তির জগৎ মৌলিকভাবে উৎপাদন ও শ্রমের শর্তকে এমনভাবে রূপান্তরিত করে যে, পুঁজিবাদের এখন আর পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হবে না। এটিকে এখন পুঁজিবাদ-উত্তর ভবিষ্যতকে জায়গা করে দিতে হবে। যদিও হুবুহু পশ্চিমের বাস্তবতায় তার যুক্তির প্রাসঙ্গিকতা আছে, কিন্তু তিনি প্রযুক্তিতে মুগ্ধ এবং ইউবিআই (UBI) এর পক্ষে ওকালতি করা অনেকও আজকাল পূর্ণ অটোমেশন এবং শ্রমকে সম্পূর্ণ অবসর দেয়ার পক্ষে। (আমার এমনই মনে হয়েছে।) এ বিষয়ে এখানে আমি বিস্তারিত যেতে চাইনা কারণ এই লেখায় আমার মূল মনোযোগ পুঁজিবাদের রূপান্তর। এমন মনে করার সত্যিই কোন কারণ নেই যে পুঁজিবাদ-উত্তর ভবিষ্যত পুঁজিবাদের ভিতর থেকেই ছোট ছোট রূপান্তরের মধ্য দিয়ে আসবে না বা আসতে পারে না। তবে সেই উত্তর-পুঁজিবাদ কেমন হবে? উপরের আমার বক্তব্যটি যদি সঠিক হয় তবে এর অর্থ সব রকমের পণ্য উৎপাদন, ক্ষুদ্র সম্পত্তির সম্পূর্ণ বিলোপ হতে পারে না; এর অর্থ সর্বজনীন, সমষ্টিগত সম্পত্তি, সমবায় ও বাজারের সম্পর্কের (এমনকি টাকাও; পল পটের কাম্বোডিয়ায় যেমনটি হয়েছিল) বিলুপ্তি হতে পারে না। এর অর্থ পণ্য উৎপাদন, যাবতীয় সম্পত্তি, বাজার সম্পর্কের রাষ্ট্রীয় প্রতিস্থাপন নয় এবং বাজারের যা করার কথা তাই করার মত কোনও কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা সংস্থার আবির্ভাবও না। প্রকৃতপক্ষে, এই জাতীয় কল্পনা চোখ বন্ধ করে ইংল্যাণ্ডকে পুঁজিবাদের ‘ধ্রুপদী রূপ’ হিশেবে ধরে নেয়ার (এমনকি খোদ মার্ক্স পর্যন্ত তাই করেছিলেন) ‘যৌক্তিক’ পরিণতি। সাধারণ সম্পত্তির বেসরকারিকরণ, কৃষক সম্পত্তিসহ সব কিছুর বুর্জোয়া ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রূপান্তর এবং কেবলমাত্র বুর্জোয়া ব্যতীত বাদবাকি সবাইকে সম্পত্তিহীন ‘সর্বহারা’য় পরিণত করা। এই বোঝাপড়াই সমস্ত রকমের সম্পত্তিকে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিতে রূপান্তরের মাধ্যমে ‘আত্মসাৎকারীদের আত্মসাৎ’ (expropriation of the expropriator) মার্কা সমাজতন্ত্রের কল্পনা হাজির করেছিল। তাত্ত্বিকভাবে, হয় সব সম্পত্তি ইতোমধ্যেই বুর্জোয়া সম্পত্তি ছিল অথবা আরো করুণ অবস্থা, কমিউনিস্টদের দ্বারা ‘বুর্জোয়া বিপ্লব সম্পন্ন’ করার মাধ্যমে সব সম্পত্তিকে আগে বুর্জোয়া সম্পত্তিতে পরিণত করতে হবে।
এমন প্রচুর কাজ বর্তমানে বিদ্যমান যেগুলো দেখাচ্ছে যে, বিংশ শতাব্দীতে ভোগের উল্লম্ফন আবশ্যিকভাবেই ‘পুঁজিবাদের অমোঘ বিধান’ ছিল না, বরং মানুষকে কীভাবে ভোগের বস্তুতে পরিণত করা যায় সেই দুরভিসন্ধি দ্বারা তাড়িত ছিল। পুরোনা শহরগুলোকে ধ্বংস করা থেকে শুরু করে এবং তাদেরকে পরে এমনভাবে ঢেলে সাজানো যেন মনে হয় অটোমোবাইল ছাড়া শহরগুলো অচল; ভোগের ক্ষেত্রে বিরাজমান রীতিনীতিকে পরিকল্পিত উপায়ে অকার্যকর করে তোলা পর্যন্ত পুরোটাই ছিল ব্যবয়াসিক ধান্দা। পুঁজিবাদী উপায়ে ফাংশন করার স্বার্থে অর্থনীতিকে ক্রমাগত ভোক্তা উৎপাদন করতে হয়েছিল এবং এই ‘দুশ্চিন্তা’ ছিলই যে, মানুষজন যদি ভোগ বন্ধ কিংবা কমিয়ে দেয় তাহলে প্রবৃদ্ধি হ্রাস পাবে। এবং এই প্রক্রিয়াগুলো জারি রাখার জন্য শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দোহাই ছিল। আমরা সবসময়ই ভেবে এসেছি যে, কেবলমাত্র অবৈতনিক শ্রমই ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’ উৎপাদন করে এবং কখনোই এই বাস্তবতা আমলে নেইনি যে (উৎপাদন-ভোগ-প্রবৃদ্ধির) পরিবেশগত মাশুল অপরিশোধিতই থেকে যাচ্ছে। কেবল ‘প্রাকৃতিক কাঁচামাল’ এর ব্যবহারের মূল্য চুকানো অর্থে নয়; বরং বাস্তুসংস্থানের ধ্বংসযজ্ঞ, বায়ু দূষণ করা, পানি দূষণ, নদী শুকিয়ে মারা এবং বর্তমানে সারা বিশ্ব যে বিপর্যয়ের কবলে পড়েছে তার মাশুল চুকানো অর্থে বলা হচ্ছে। এই লেখাটিতে আমরা রবার্ট ওয়ালেসের ২০১৬ সালে লিখিত বই-Big Farms Make Big Flu‘র উপর ভিত্তি করে সাম্প্রতিক প্রকাশিত, চীনের অণুজীববিজ্ঞান সংক্রান্ত শ্রেণীযুদ্ধ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে গ্রাফ সহকারে যা বর্ণিত হয়েছে, সেই প্রসঙ্গটি আলোচনা করিনি। প্রবন্ধটি ভবিষ্যতে আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করে থাকতে পারে তা প্রকাশ করেছে। বিজ্ঞানীরা আরও আশঙ্কা করছেন যে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে গলতে থাকা হিমবাহগুলো বরফের একেবারে নিচে চাপা থাকা সুপ্ত ভাইরাসগুলোকেও উন্মুক্ত করবে। আমরা যদি অপরিশোধিত শ্রমের সাথে পুঁজিসৃষ্ট পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির মূল্য বিচার করি তাহলে ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’ বলে আর কিছুই বাকি নেই। ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’ -এর কল্পকাহিনী কেবল ততক্ষণই বজায় রাখা যেতে পারে যতক্ষণ পর্যন্ত ধ্বংসযজ্ঞ ও চরম অপচয়কে আমলে না নিয়ে সম্পদসৃষ্টির হিসাব একদিক বিবেচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। শেষ পর্যন্ত, এটি কেবল শূন্য সমষ্টির গেইম (zero sum game) কিংবা আরো খারাপ পরিস্থিতিতে নেতিবাচক সমষ্টির গেইম ( negative sum game) এ পরিণত হতে পারে। পুঁজিবাদের পরের জীবন নিশ্চিতভাবেই চিন্তনীয় যদি আমরা পুঁজিবাদকে ভিন্নিভাবে চিন্তা করতে শিখি। পুঁজিবাদকে কেবল আর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শ্রমিক শ্রেণীর এন্টি-থিসিস (anti-thesis) হিশেবে ভাবাই যথেষ্ট নয়, পুঁজিবাদ আজকে সমগ্র মানব অস্তিত্বের বিরুদ্ধে অর্থাৎ ৯৯ ভাগের বিরুদ্ধে অবস্থান করছে। এই পরিস্থিতিতে ব্যক্তিগত মালিকানা বনাম রাষ্ট্রীয় মালিকানা কিংবা বাজার বনাম রাষ্ট্রের অত্যন্ত ক্লিশে তর্ককে ছাপিয়ে প্রথমবারের মতো পুঁজিবাদকে অতিক্রম করে এমন জীবনের সম্ভাবনা আমরা দেখতে পাচ্ছি।
অনুবাদকের টীকা
১. এই প্রবন্ধটিতে প্রবেশ করার একটি অন্যতম চাবিশব্দ হচ্ছে ‘বায়োপলিটিকস’ তথা ‘জৈব রাজনীতি’। বায়োপলিটিকস শব্দটির ভিন্ন ভিন্ন অর্থ থাকলেও এই প্রবন্ধে এটি মূলত ফুকোডিয়ান বায়োপলিটিকস হিশেবেই ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ ফরাসি তাত্ত্বিক ও দার্শনিক মিশেল ফুকো যে অর্থে শব্দটি ব্যবহার করতেন সেই অর্থে। জৈবরাজনীতির ফুকোডিয়ান তাৎপর্য হচ্ছে, মানুষের জীবন সার্বভৌম রাজনীতির কেন্দ্রীয় বিষয়ে পরিণত হওয়া। এটি আধুনিক ক্ষমতাতন্ত্রের এমন এক প্রকৌশল যা জীবনকে নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলিত করে।
প্রাচীন বা মধ্যযুগের সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন রাজা। তিনিই সব ক্ষমতার উৎস ছিলেন। তাঁকে অমান্য করলে কঠোর শাস্তির বিধান ছিল এবং সেটা প্রয়োগ করা হতো প্রকাশ্যে, সর্ব সম্মুখে। যাতে করে প্রজাগণ বুঝতে পারে সার্বভৌম ক্ষমতাকে অগ্রাহ্য করলে কী ভয়াবহ শাস্তি পেতে হয়। কিন্তু রাজতন্ত্রের পতনের সাথে সাথে পাল্টাতে থাকে শাস্তির ধারণা ও প্রকৌশল। আঠারো শতকে বুর্জোয়া বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার পর ইউরোপের সর্বত্রই এই শাস্তি প্রদানের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ শুরু হয়। ফলে আবিষ্কৃত হয় ‘শাস্তির নম্র উপায়’। মধ্যযুগে প্রজার প্রাণ হরণের মধ্যে নিহিত ছিল সার্বভৌম শাসকের চূড়ান্ত ক্ষমতা। আধুনিক রাষ্ট্রে মানুষের জীবনকে শৃঙ্খলিত করা ও অনুশাসনের ছকে আবদ্ধ করার মত শাসনপ্রণালী গড়ে উঠেছে।
তারপরেও মানুষকে বধযোগ্য প্রাণে পরিণত করার মত মধ্যযুগীয় চর্চাও আধুনিক রাষ্ট্রের জৈবরাজনীতির অংশ। রিমান্ডে টর্চার থেকে শুরু করে এনকাউন্টার-ক্রসফায়ার এর অংশ। পার্থক্য শুধু এই যে আধুনিক রাষ্ট্র মানুষের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার এমন সব কলাকৌশল রপ্ত করেছে যা রাজতন্ত্রের সার্বভৌম রাজার পক্ষে অকল্পনীয় ছিল।
ফুকো মনে করতেন, আধুনিক ক্ষমতাকে কেবল কেতাবী সংজ্ঞায় বোঝা সম্ভব নয়। ক্ষমতাকে বুঝতে হবে তার কার্যকলাপ, প্রয়োগ ও বিস্তারের মাধ্যমে। এই আধুনিক ক্ষমতার একটা জৈবিক অস্তিত্ব রয়েছে। এটি হচ্ছে ক্ষমতার সেই প্রকৌশল যা দিয়ে রাষ্ট্র নাগরিক জনগোষ্ঠীকে শাসনের অনুকূল বশ্য জনগোষ্ঠীতে পরিণত করে। তাদের জীবন-মৃত্যুর উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। পরিবার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে মহামারি নিয়ন্ত্রণ পর্যন্ত মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি নিজের শরীরও হয়ে ওঠে ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্র। জৈব রাজনীতির মাধ্যমে আধুনিক শাসনপ্রণালী নাগরিকের জীবনের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। জীবন হয়ে ওঠে রাজনৈতিক কলাকৌশল প্রয়োগের অবজেক্ট। পুলিশ, আইন-আদালত, ক্লিনিক, কারাগার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র ও আপাত অর্থে রাষ্ট্র নয় এমন সব প্রতিষ্ঠান এবং মাইক্রো থেকে ম্যাক্রো লেভেল পর্যন্ত জীবনকে কেন্দ্র করে জৈব রাজনীতির চর্চাই ‘আধুনিক’ রাষ্ট্র-শাসনপ্রণালীর অন্যতম প্রধান চিহ্ন। তবে এই জৈবরাজনীতি এতদিন পর্যন্ত ছিল রাজনৈতিক লক্ষ্য, করোনা মহামারির কালে তা নতুন সম্পর্কপ্রণালী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে-শরীর মাত্রই ‘সন্দেহজনক’, আচরণ মাত্রই ‘বিশেষ সতর্কতা’। আদিত্য নিগাম এই ভয়াবহতাকেও খেয়াল রাখা কথা বলছেন।
[২] গ্রীন নিউ ডিল (জিএনডি) হলো জলবায়ু পরিবর্তন এবং বিপুল অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত আইনের প্যাকেজ। গ্রীন নিউ ডিলের উদ্দেশ্য হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে খারাপ পরিণতি এড়াতে গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমনের মাত্রা ন্যূনতম পর্যায়ে নিয়ে আসা এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং জাতিগত বর্ণবাদের রাষ্ট্রীয় সমস্যাকে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করা। ২০১৮ সালে প্রকাশিত জাতিসংঘের রিপোর্ট এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল বিজ্ঞানীদের দুটি রিপোর্টের উপর ভিত্তি করেই মূলত গ্রিন নিউ ডিলের পক্ষের রাজনীতিবিদ ও অ্যাক্টিভিস্টরা তাঁদের যাবতীয় প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে থাকেন। রিপোর্টগুলোতে বলা হয়েছে, যদি তাপমাত্রা বাড়তেই থাকে তাহলে তীব্র তাপপ্রবাহ, দাবানল এবং খরা দুনিয়ার পরিবেশ-প্রতিবেশকে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত করবে। আরো বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ক্ষতির মুখোমুখি হবে। গ্রিন নিউ ডিলের সমর্থকরা মনে করেন, কেবলমাত্র প্রযুক্তিগত পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়, বরং সামাজিক-রাষ্ট্রিক সকল প্রকারের বৈষম্য, নিপীড়নের অবসানের মধ্যেই মানবসভ্যতার ভবিষ্যত নিহিত।তথ্যপঞ্জি
দীপেশ চক্রবর্তী ( ২০১৬) ‘আরেক টোয়েন্টি টোয়েন্টি: পৃথিবীর উষ্ণতা-বৃদ্ধি ও মানুষের ইতিহাস’; ইতিহাসের জনজীবন ও অন্যান্য প্রবন্ধ ; আনন্দ পাবলিশার্স, তৃতীয় মুদ্রণ, কলকাতা