- অনুবাদ: মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার
ভূমিকা: এমা গোল্ডম্যান, ১৮৬৯ সালে বিপ্লবপূর্ব রাশিয়ায় জন্ম নেয়া একজন প্রখ্যাত অরাজবাদী বা এনার্কিস্ট তাত্ত্বিক, বামপন্থী রাজনীতিবিদ, দার্শনিক এবং নারীবাদী তাত্ত্বিক। এমা গোল্ডম্যান ছিলেন তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক কর্মবাদিতার এক বিরল মিশ্রণ। তিনি একদিকে যেমন রচনা করেছেন অরাজবাদী রাজনৈতিক-দার্শনিক তত্ত্ব, তেমনি ঘুরে বেড়িয়েছেন সারা দুনিয়া, অরাজবাদী ও মুক্তিমুখিন আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্যে। বিপ্লবী রাজনীতির জন্যে সাজা পেয়েছেন, বন্দি হয়েছেন, কারাবাস করেছে বহুবার। তাঁর নারীবাদিতা সমাজ পরিবর্তন থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু ছিলো না, তাঁর নারীবাদিতা সমাজের রাজনৈতিক- অর্থনৈতিক রূপান্তরের সাথেই যুক্ত ছিলো। এই প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয় এনার্কিজম এন্ড আদার এসেজ গ্রন্থে ১৯১০ সালে। এরপর ১৯১১ সালে এর পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশ করে মাদার আর্থ পাবলিকেশন । প্রবন্ধটি ১৯০৮ সালে বসন্ততে লেখা।
গোল্ডম্যান, এটি রচনা করেন আজ থেকে প্রায় একশ এগারো বছর আগে । তাই প্রবন্ধটি পাঠ করার সময় সেই পরিপ্রেক্ষিতকে মনে রাখা দরকার। বিশেষত, বাংলাদেশে বা পৃথিবীর একটা বড় অংশের জন্যে এই প্রবন্ধটি আজও ভীষণ রকমের প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের অগ্রসর শহুরে নারীবাদীদের জন্যে হয়তো এই প্রবন্ধটি খুব আগ্রহউদ্দীপক নাও হতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মুক্তিকামী নারীদের জন্যে একশো এগারো বছরের পুরোনো এই প্রবন্ধটি নিশ্চিত ভাবে আজও সমান প্রাসঙ্গিক ও আগ্রহ উদ্দীপক মনে হবে। এই লেখাটিকে আরেকটি প্রসঙ্গেও দেখা যেতে পারে। এই প্রবন্ধটি আমাদের নর ও নারীর এক বিকল্প সম্পর্কের কথা বলছে। রাষ্ট্র আর চার্চ-মসজিদ- মন্দির নিয়ন্ত্রিত নর-নারীর সম্পর্কের বদলে মানুষের সত্যিকারের মানবিক সম্পর্কের কথা বলছে। যারা সমাজ বদলের কথা বলেন তাদের জানা দরকার যে, মানুষে-মানুষে সম্পর্ক আসলে সমাজ বদলেরই অংশ। সম্পর্ককেও বদলাতে হবে, মানুষের সম্পর্ক হবে বন্ধনহীন, কেবল প্রেম ও মর্যাদার উপরে ভিত্তি করে। সেটাই এমা এখানে বলতে চেয়েছেন।
অনুবাদ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে, এমা গোল্ডম্যান যে ইংরাজিতে লিখেছেন তা সহজ কিন্তু সেই ইংরাজির চলনটি প্রায় একশো বছরের পুরোনো, মূল প্রবন্ধটির উৎস কপিতে দুয়েকটি স্থানে মুদ্রণ প্রমাদও রয়েছে। আমি দাবি করছি না এটা একশো ভাগ উতরে যাওয়া একটি অনুবাদ; কিন্তু আমি চেষ্টা করেছি। অন্তত তথ্য, ব্যাখ্যা ও দৃষ্টিভঙ্গিগত ভাবে চেষ্টা করেছি সম্পূর্ণ মূলানুগ থাকার জন্যে। প্রবন্ধটির মূল বক্তব্যের দায় অনুবাদকের নয়, তবে অনুবাদ প্রসঙ্গে যেকোনো সমালোচনা, পরামর্শ আনন্দের সাথে গ্রহণ করবো।
মূল প্রবন্ধ
বিয়ে এবং প্রেম নিয়ে জনপ্রিয় ধারণাটি হচ্ছে, আমরা মনে করি এই দুটি বিষয় আসলে একই এবং সমার্থক, উদ্দেশ্যগত দিক থেকে এরা সম্ভবত একই উদ্দেশ্য থেকে জন্ম নেয় এবং উভয়েই মানুষের একই রকমের প্রয়োজন মেটায়। প্রায় সকল জনপ্রিয় ধারণার মতোই এই ভাবনাটিও কোনো ফ্যাক্ট বা বাস্তব তথ্যের উপরে প্রতিষ্ঠিত নয়, বরং এই ভাবনার ভিত্তিমূল হচ্ছে আমাদের প্রথাগত সংস্কার কিংবা কুসংস্কার।
বিয়ে ও প্রেমের মাঝে কোনো সাধারণ ঐক্য নেই, বরং এই দুটি খুবই দূরের দুই মেরুর বিষয় এবং বাস্তবত এরা পরস্পর বিরোধীও বটে। কোনো সন্দেহ নেই যে, কিছু কিছু বিয়ে ভালোবাসা বা প্রেমেরই ফসল। এটা একারণে নয় যে, প্রেম কেবল বিয়ের মধ্যে দিয়েই প্রকাশিত হতে পারে, বরং এটা একারণে যে, খুব কম সংখ্যক মানুষই আসলে প্রথার বাইরে বেরিয়ে নিজেকে বিকশিত করে তুলতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ের বহু মানুষের কাছেই বিয়ে একটা প্রহসন ছাড়া কিছুই নয়, কিন্তু তারা এই প্রহসনের কাছে নিজেদের সমর্পণ করেন স্রেফ জনমতের চাপে পড়ে। যেকোনো হিসাবেই এটা সত্য যে, কিছু বিয়ে ভালোবাসা বা প্রেমের টানেই হয়ে থাকে। আবার এটাও সত্য যে, কিছু কিছু বিবাহিত জীবনে সেই ভালোবাসা বা প্রেম সমান ভাবেই বজায় থাকে, অথবা সেটা বজায় থাকে বিয়ে করা বা না করা এসবের কোনো তোয়াক্কা না করেই।
অন্যদিকে এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা যে, বিয়ে থেকে প্রেমের জন্ম হয় । খুব বিরল ও অলৌকিক দুয়েকটি ঘটনায় জানা যেতে পারে যে, বিবাহিত দম্পতি তাদের পরস্পরের প্রেমে পড়েছেন বিয়ের পরে, কিন্তু খুব কাছ থেকে অনুসন্ধান করলে জানা যাবে এই বিবাহিত জীবনের প্রেম আসলে অমোঘ বাস্তবতাকে মেনে নেয়ার, মানিয়ে নেয়ার কুশলী প্রচেষ্টা মাত্র। এটা প্রায় নিশ্চিত যে, বিয়ের পরে দুজনের একসাথে বেড়ে ওঠার সাথে প্রেমের সম্পর্কের যে স্বতঃস্ফূর্ততা, আবেগের প্রাবল্য এবং সৌন্দর্য তার তফাৎ অনেক। আর প্রেমের সম্পর্কের এই যে স্বতঃস্ফূর্ততা, প্রাবল্য এবং সৌন্দর্য এসব ছাড়া বিবাহিত জীবনের এই একসাথে থাকা পুরুষ ও নারী উভয়ের জন্যে অর্থহীন দিনযাপন ছাড়া আর কিছুই নয়। বিয়ে মূলত একটি অর্থনৈতিক চুক্তি, ব্যবস্থা, প্রধানত অর্থনৈতিক নিরাপত্তাজনিত চুক্তি, অনেকটা ‘ইনস্যুরেন্স’ জীবনবীমার মতো। প্রথাগত জীবনবীমার সাথে এর তফাৎ টা হচ্ছে, জীবনবীমার তুলনায় বিয়ে আরও অনেক বেশি জবরদস্তিমূলক, আরও অনেক বেশি বাঁধাধরা নিয়মের অধীন। জীবনবীমায় বিনিয়োগ ও প্রাপ্তির তুলনায় বিয়েতে প্রাপ্তিযোগ খুবই সামান্য। জীবনবীমা পলিসিতে একজন ক্রেতাকে কিস্তি পরিশোধ করতে হয় টাকায় আনায় গুনে গুনে, কিন্তু ক্রেতা এখানে সবসময়ই স্বাধীন, তিনি চাইলেই এই কিস্তি দেয়া বন্ধ করে দিতে পারেন। বিয়ের ক্ষেত্রে যদি স্ত্রীর জন্যে তাঁর স্বামী হন তার কিস্তি বা প্রিমিয়াম, তিনি এর বদলে যা পরিশোধ করেন তা হচ্ছে নিজের নাম, নিজের একান্ত ব্যক্তিগত সত্ত্বা, আত্মসম্মান আর সবচাইতে বড় কিস্তি হচ্ছে তার নিজের জীবন। আমৃত্যু এই কিস্তি বা ‘প্রিমিয়াম’ পরিশোধ করতে হয় নিজের জীবন দিয়ে। আর এর বিনিময়ে তাকে শুনতে হয় নানান ধরনের গঞ্জনা। পরনির্ভরশীলতা, পরজীবিতা আর অপদার্থ জীবনের গঞ্জনা, ব্যক্তিগত পর্যায়ে এবং সামাজিক পর্যায়েও শুনতে হয় এসব অপমান আর গঞ্জনা। পুরুষকেও তার দেনা শোধ করতে হয়, কিন্তু পুরুষের পৃথিবী যেহেতু অনেক বিস্তৃত তাই বিয়ে তাকে নারীর মতো সীমিত করে দেয় না। বরং বিয়ে হচ্ছে পুরুষের জন্যে এক ধরনের অর্থনৈতিক শিকল।
সেজন্যেই দান্তে’র সব পুড়িয়ে দেয়া আগুনের দাবানল সমান শক্তি নিয়েই হাজির থাকে বিয়ের বেলাতেও। যেমনটা তিনি বলেছেন– ‘যে এই সম্পর্কে প্রবেশ করে সে সকল আশা পেছনে ফেলে আসে’।
বিয়ে একটা ব্যর্থ প্রপঞ্চ, এটা কেবল অতি নির্বোধেরাই অস্বীকার করবে। শুধু বিবাহ বিচ্ছেদের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে বিয়ে কি তিক্ত এক ব্যর্থতার নাম। অথবা হয়তো কেউ আক্রমণাত্মক কুযুক্তি দেবে যে, বিবাহ বিচ্ছেদ আইনের বিস্তৃতি বা শিথিল হওয়া কিংবা নারীদের আরও মুক্ত জীবনযাপন করার প্রবণতার বৃদ্ধির ফলে, প্রথমত – প্রতি বারোতম বিয়ে আসলে বিচ্ছেদে পর্যবসিত হচ্ছে, দ্বিতীয়ত – ১৮৬৭ সালের পর থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের হার বৃদ্ধি পেয়েছে প্রতি এক লক্ষে ২৮ থেকে ৭৩ এ, তৃতীয়ত – ১৮৬৭ সাল থেকে বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ হিসাবে পরকীয়া প্রেমের অভিযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ২৭০.৮% এবং চতুর্থত – সঙ্গীকে ছেড়ে চলে যাওয়ার হার বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৩৬৯,৮%।
এই বিস্ময়কর এবং খানিকটা আতঙ্কজনক সংখ্যাগুলোর অনেকটাই বাস্তব, নাটকীয় এবং এই বিষয়ে আরও অনেক বেশি আলোকিত করে। Robert Herrick এর লেখা বই Together, Pinero তাঁর লেখা বই Mid-Channel কিংবা Eugene Walter এর Paid in Full বা এই রকমের আরও অসংখ্য বইয়ের লেখকেরা বিবাহিত সম্পর্কের ভয়াবহ অনুর্বরতা, একঘেয়েমি, নোংরামি ও সীমাবদ্ধতাকে আলোচনা করেছেন এই সম্পর্কের সঙ্গতি আর বোঝাপড়া প্রসঙ্গে। চিন্তাশীল মানুষেরা কিংবা সমাজবিদ্যার আগ্রহী শিক্ষার্থীরা এ বিষয়ে জনপ্রিয় ও উপরভাসা ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হবেন না। তারা বরং আরও গভীর অনুসন্ধান করবেন উভয় পক্ষের দিক থেকেই কেনো বিয়ে নামের সম্পর্কটা এতোটা অকার্যকর প্রমাণিত হচ্ছে।
এডওয়ার্ড কারপেন্টার (Edward Carpenter) বলছেন, প্রতিটি বিবাহের পেছনেই আসলে দুটি আলাদা মানুষের ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত দাঁড়িয়ে থাকে। এই পরিপ্রেক্ষিতের ভিন্নতা দুজন মানুষের বেলায় এতোটাই তফাৎ হয় যে, দুজন মানুষকে হয়তো চিরকালই পরস্পরের কাছে এক রকমের অচেনা মানুষ হয়ে থাকতে হয়। প্রথা, সংস্কার, অভ্যাসের ভিন্নতার এক দূরাতিক্রম্য দেয়াল দিয়ে আলাদা হয়ে থাকা এই সম্পর্কের মাঝে পারস্পরিক জ্ঞান ও সম্মান তৈরি হবার কোনো সুযোগ নেই, ফলে এই আপাত মিলনের সম্পর্কের প্রায় সবকটিই ব্যর্থ হতে বাধ্য। হেনরিক ইবসেন (Henrik Ibsen) সম্ভবত আমাদের ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তি যিনি এই সত্যটি বুঝতে পেরেছিলেন। নোরা তার স্বামীকে ছেড়ে যায় এটাকে হয়তো কোনো নির্বোধ সমালোচক বলবেন যে, সে আসলে তার দায়িত্ব নিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো অথবা সে হয়তো নারীর অধিকারের দাবি করেছিলো, প্রকৃত সত্য হচ্ছে আট বছরের সংসার জীবনে নোরা জেনে গিয়েছিলো যে, সে একটি অচেনা পুরুষের সাথে ঘর করছে, তার জন্যে সন্তান উৎপাদন করেছে। দুজন অচেনা মানুষের এতো কাছাকাছি সারাজীবন বসবাস করার চাইতে অবমাননাকর, অমর্যাদাকর আর কিছু হতে পারে কি? পুরুষের টাকা পয়সা হিসাব করে গচ্ছিত রাখার বেশি আর কিছু জানার দরকার নেই নারীর জন্যে। নিজের সুখী সুখী মুখশ্রীটি ধরে রাখার কৌশল শেখার বাইরে আর কি করার আছে একজন নারীর? নারীর প্রসঙ্গে আমরা তো এখনও সেই ধর্মতাত্ত্বিক পুরাণের বাইরে যেতে পারিনি যেখানে নারীর কোনো আত্মা নেই, সে কেবল পুরুষের অপ্রয়োজনীয় অতিরিক্ত অংশ, পুরুষের পাঁজরের হাড় থেকে তৈরি, কেবল সেই ভদ্রলোকের সুবিধার জন্যে সৃষ্ট, যে লোকটি এতোটাই শক্তিমান যে তার ছায়াকেও ভয় পায়। কে জানে, হয়তো নারীই দায়ী তার সৃষ্টির জন্যে, তার সৃষ্টি প্রক্রিয়ার নিচুতার জন্যে। সকল অর্থেই নারীর আত্মা হচ্ছে উনমানুষের আত্মা, বরং সে পূর্ণ হয়ে ওঠে স্ত্রী হিসাবে, যে কিনা খুব সহজেই বিলীন হয়ে যেতে পারে তার স্বামীর মাঝে। এই রকমের দাসত্বসূলভ আত্মসমর্পণই পুরুষের উৎকৃষ্টতাকে টিকিয়ে রাখে আর যুগ যুগ ধরে টিকিয়ে রাখে বিয়ে নামের জগদ্দল পাথর প্রতিষ্ঠানটিকে। এখন নারী তার আপন সত্ত্বা সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে, সে তার প্রভুর মহিমা থেকে বেরুতে শিখছে, তাই বিয়ে নামের পবিত্র মহিমান্বিত প্রতিষ্ঠানটি ভেঙ্গে পড়ছে এবং খুব সামান্যতম আবেগী অনুশোচনাও এখন একে ধরে রাখতে পারবে না।
শিশুকাল থেকেই গড়পড়তা একটি মেয়েকে বলা হয়ে থাকে যে, বিয়ে হচ্ছে তার জীবনের একটি চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন, সেজন্যেই তার সকল শিক্ষা-দীক্ষার আয়োজন চলে এই অর্জনের কথা মাথায় রেখে । অনেকটাই সেই অবলা প্রাণীর মতো যাকে মোটাতাজা করে তোলা হয় কেবল জবাই করার জন্যেই এবং সেও যেনো তৈরি হয় এই পরিণতির জন্যেই। তবুও হয়তো অবাক শোনাবে যে, স্ত্রী এবং মা হিসাবে নারীর ভূমিকাটি সম্পর্কেও তাকে খুব একটা জানতে দেয়া হয় না, যেকোনো একজন সাধারণ শ্রমিক, শিল্পী বা কারিগর তার পেশাকে যতটুকু জানে সেই তুলনায়। যদিও প্রথাগত ভাবে যেকোনো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মেয়ের পক্ষে বিবাহিত জীবন সম্পর্কে জানাটা খানিকটা অভদ্রতা ও ঘিনঘিনে । মর্যাদাবোধের অসমতার জন্যেই, বিয়ে নামের এই প্রতিষ্ঠানটিকে যা আদতে খুবই নোংরা, তাকে পরিণত করা হয় বিশুদ্ধতম ও পবিত্রতম একটা ব্যবস্থা হিসাবে যার বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলার বা সমালোচনা করার সাহস পর্যন্ত করা যায় না। এটাই হচ্ছে বিয়ে প্রথার সমর্থক একজন মানুষের অবস্থান। আর এই ভবিষ্যত স্ত্রী ও মা’কে যে বিষয়টি গোপন করা হয় তা হচ্ছে, বিয়ের বাজারের এই প্রতিযোগিতামূলক পরিপ্রেক্ষিতে তার একমাত্র সম্পদ সম্পর্কে– সেটা হলো তার ‘যৌনতা’ বা সেক্স। ফলে এই প্রথার বলি হয়ে একটা পুরুষের সাথে সে প্রবেশ করে একটা জীবনভর সম্পর্কে যেখানে সব আছে, আঘাত, গঞ্জনা, ক্রোধ এবং পরিমাপ করা যায় না এমন অনেক কিছুই, কেবল নেই সবচাইতে স্বাস্থ্যকর ও স্বাভাবিক প্রবৃত্তির চর্চা– ‘যৌনতা’ বা সেক্স। এটা বরং বলাই বাহুল্য যে, বিবাহিত জীবনের অসুখীবোধ, দুর্ভোগ, মর্মপীড়া কিংবা শারীরিক দুর্ভোগের একটা বড় কারণ হচ্ছে যৌনতা বিষয়ে ভয়ঙ্কর অজ্ঞতা এবং বিবাহ প্রথায় এই অজ্ঞতাকেই মনে করা হয় মহান গুণ। যখন আমি বলি যে এই শোচনীয় বাস্তবতার জন্যে একাধিক ঘর ভেঙ্গে গেছে, আমি এটা মোটেও বাড়িয়ে বলি না।
একটি মেয়ে যদি প্রাপ্তবয়স্ক ও স্বাধীন হয় এবং রাষ্ট্র ও চার্চের আপত্তি পার হয়ে যদি সে যৌনতার গোপন রহস্য সম্পর্কে জানতে চায়ও কিংবা পারে, তাহলে সে চিরতরে অযোগ্য হয়ে যাবে কোনো একজন ‘ভালো’ পুরুষের বিবাহিত স্ত্রী হওয়া থেকে, এমন কি সেই ‘ভালো’ পুরুষটি যদি নির্বোধ আর কেবল টাকাওয়ালা কোনো একজন গড়পড়তা মানুষও হয়ে থাকেন। প্রত্যাশাটি হচ্ছে এমন যে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক, শারীরিক ভাবে সুস্থ্য নারী, যার জীবনে আবেগের কোনো কমতি নেই, তাকে তার প্রাকৃতিক শারীরিক চাওয়াকে বাতিল করে দিতে হবে, তার গভীর আবেগ কে সামাল দিতে হবে, নিবিড় যৌন অভিজ্ঞতা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে কেবল একজন ‘ভালো’ পুরুষের অপেক্ষায়, কবে একজন ‘ভালো’ পুরুষ এসে তাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়ে উদ্ধার করবে সেই প্রত্যাশায়, এর চাইতে অমর্যাদাকর কোনো প্রস্তাবনা হতে পারে? কিন্তু বিবাহ নামের প্রথা ও প্রতিষ্ঠানটি আসলে এটাই বলে, এটাই বিয়ের চূড়ান্ত অর্থ। এই ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান বা ব্যবস্থার পরিণতি ব্যর্থতা ছাড়া আর কি হতে পারে? বিয়ের সাথে প্রেমের তফাতের এটা একটা কারণ এবং এটা খুব ছোট কোনো কারণ নয়।
আমাদের সময় হচ্ছে বাস্তবতার সময়। যখন রোমিও জুলিয়েট প্রেমের জন্যে তাদের পিতাদের কোপানলে পড়ার ঝুঁকি নিয়েছিলো, যখন গ্রেচেন তাঁর প্রেমের জন্যে পাড়া প্রতিবেশীর মুখরোচক খোশগল্প আর নিন্দাকেও মেনে নিয়েছিলো, সেই সময় এখন আর নেই যে, যদি কোনো বিরল ঘটনায় তরুণ- তরুণী রোম্যান্টিক হতে যায় তাহলে অভিভাবকেরা তাদের ধরে এমন শায়েস্তা করেন যেনো তাদের কাণ্ডজ্ঞান ফিরে আসে।
একটা মেয়ের জন্যে নীতিগত শিক্ষাটা এটা নয় যে, একজন পুরুষ তাকে প্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছে কিনা, প্রশ্নটা বরং ‘কতটুকু’ করেছেন, কতটুকু পেরেছেন? আমাদের আমেরিকান জীবনে একমাত্র সত্য ঈশ্বর হচ্ছে পুরুষটির কি আয় রোজগার আছে? সেকি তার নিজের জীবন নির্বাহ করতে পারে? শুধু এই প্রশ্নটাই বিয়ে প্রথাকে জায়েজ করে। এটা যখন নিশ্চিত হয়ে যায়, তারপর থেকে মেয়েটির চিন্তা ভরে উঠতে থাকে নানান স্বপ্নে। তার স্বপ্ন পূর্ণিমা রাতে প্রেমিকের চুম্বন নয় কিংবা নয় ভালোবাসার হাসি-কান্নার আবেগ, বরং তার চিন্তা ভরে ওঠে অভিজাত কেনাকাটা আর এই ধরনের বিষয়াদিতে। আত্মার দারিদ্র আর নোংরামি বিবাহ নামের প্রতিষ্ঠানটির সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। রাষ্ট্র ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কাছে এর চাইতে উৎকৃষ্ট ভিন্ন কোনো আদর্শ নেই, কেননা নারী ও পুরুষকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে এটাই সবচাইতে কার্যকর প্রতিষ্ঠান।
কোনো সন্দেহ নেই যে, কিছু মানুষ এখনও প্রেমকে টাকাপয়সার চাইতে উপরে স্থান দেন। বিশেষত সেই শ্রেণীর জন্যে যাদের অর্থনৈতিক চাহিদার প্রশ্নটি তাদেরকে স্বনির্ভর হতে বাধ্য করেছে। এখন নারীর অবস্থানের একটা দারুণ পরিবর্তন এসেছে, অনেক পোড় খেয়ে অবশেষে নারীর অবস্থানের এই পরিবর্তন, খুব বেশিদিন আগের নয় যদিও, অর্থাৎ যেদিন থেকে নারী শিল্প শ্রমিক হিসাবে প্রবেশ করলো। প্রায় ষাট লক্ষ মজুরি শ্রমিক, হ্যাঁ ষাট লক্ষ নারীর প্রবেশ শ্রমবাজারে, যাদের রয়েছে পুরুষের মতোই শোষিত হবার সমান অধিকার, নিঃস্ব হবার সমান অধিকার, ধর্মঘট করার সমান অধিকার, এমন কি ভুখা থাকারও সমান অধিকার। এর চাইতে বেশি কিছু কি চায় আর? হ্যাঁ, প্রায় ষাট লক্ষ নারী শ্রম বাজারের প্রতিটি স্তরে, সবচাইতে বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ থেকে শুরু করে খনি শ্রমিকের মতো সবচাইতে শারীরিক পরিশ্রমের কাজে, রেল লাইন নির্মাণের কাজে এমন কি ডিটেক্টিভ বা পুলিশের কাজেও নারী। সুতরাং নিশ্চিত ভাবেই নারীর জাগরণ তো সম্পন্ন হলো, তাই না?
কিন্তু এর পরেও এই সবকিছু নিয়েও এই বিরাট নারী শ্রমজীবীদের একটা ছোট্ট অংশ কাজকে স্থায়ী কোনো বিষয় বলে ভাবেন, ঠিক যেভাবে পুরুষেরা ভাবতে পারেন। যতই ভগ্নদশা হোক না কেনো, পুরুষ শিশুকাল থেকেই শিখেছে নিজেকে শক্তিমান ও স্বাধীন ভাবতে। আহা, অথচ আমি জানি আমাদের অর্থনৈতিক জাঁতাকলে কেউই স্বাধীন মানুষ নন, কিন্তু তবুও পৃথিবীর দরিদ্রতম পুরুষটিও নিজেকে পরজীবী ভাবতে চায় না, যদিও সে হয়তো সকল অর্থেই সেরকমটাই। নারী নিজেকে মনে করে অস্থায়ী শ্রমিক, অনেকটা নিলামের জন্যে পাশে সরিয়ে রাখা শ্রমিকের মতো। সেজন্যেই শ্রমবাজারের শ্রমিক হিসাবে নারীর জন্যে সংগঠিত হওয়াটা পুরুষের তুলনায় এতোটা কঠিন। ‘আমি এইসব ইউনিয়নে যোগ দেবো কেনো? আমি তো বিয়ে করে সংসারী হবো, একটা ঘর হবে আমার’। একজন কন্যা শিশুকে কি তার জন্মের পর থেকেই এই শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলা হয়নি যে, ঘরকন্যাই তার জীবনের চূড়ান্ত মোক্ষ? ছোট বেলা থেকেই খুব শিগগিরই সে শিখে ওঠে যে, ঘরটা একটা কারখানার মতো বিরাট কিছু না হলেও তার দরোজা-জানালা গুলো দারুণ মজবুত। এই ঘরের একজন সেবক বা খাদেম আছেন যার পালাবার কোনো উপায় নেই। সবচাইতে করুণ দিক হচ্ছে যে, এই ঘর তাকে কখনই তার দাসত্ব থেকে মুক্তি দেয় না বরং দাসত্বের পরিমাণই কেবল বাড়িয়ে চলে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী নিউ ইয়র্ক শহরের শ্রমজীবীদের শতকরা ১০ ভাগ বিবাহিত এবং এরপরেও তাদেরকে দুনিয়ার সবচাইতে স্বল্প মজুরিতে কাজ চালিয়ে যেতে হচ্ছে। আর এর সাথে যুক্ত হচ্ছে ঘরের কাজ নামের সংসারের গোলামি। এর পরে আর কি থাকলো এই তথাকথিত ঘর কে মহিমান্বিত করার জন্যে? এমন কি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরাও বিয়ের পরে তাদের ঘরে কিংবা ঘর সম্পর্কে কথা বলতে পারে না, কেননা ঘর ও বাহির দুই জগতই তৈরি হয় পুরুষের হাতে। স্বামী নিষ্ঠুর নাকি প্রেমিক স্বভাবের সেই প্রশ্নটা আসলে কোনো অর্থ বহন করে না এক্ষেত্রে। আমি যেটা বলতে চাচ্ছি তা হলো, বিয়ে একজন নারীকে একটা ঘর নিশ্চিত করে কিন্তু সেই ঘরের সকল দেয়াল জুড়ে থাকে ঘরের পুরুষটির মহিমাকীর্তন। স্ত্রী’টি বছরের পর বছর যে ঘরে হেঁটে বেড়ান, কাজ করেন সেটা আসলে তার স্বামীর ঘর, পুরুষের ঘরে সারাদিন হেঁটে বেড়ানো নারী হয়ে থাকেন স্ত্রী’টি যতক্ষণ না তার জীবন এবং সামাজিক সম্পর্ক তার চারপাশের পরিবেশের মতোই তরঙ্গবিহীন, সংকীর্ণ হয়ে ওঠে। আর কোনো ভাবে নারীটি যদি ঘ্যানঘ্যান করা, সস্তা, ঝগড়াটে আর ফালতু খোশগল্প করা স্বভাবের হয় তা হয়তো পুরুষটিকে ঘরের বাইরে তাড়া করে কিন্তু নারীর ঘরের বাইরে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। এই পৃথিবীতে যে নারী একবার ঘরে ঢুকেছে, তার আর বাইরে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই, সে চাইলেও তার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। বিবাহিত জীবনের খুব ছোট একটা অংশ বাদ দিলে, বাকি সময়টিতে নারীটির সকল কিছুর আত্মসমর্পণ ঘটে। এই আপাদমস্তক আত্মসমর্পণ একজন সাধারণ নারীকে বহির্জগতের জন্যে একেবারেই অনুপযুক্ত করে তোলে। সে মুখশ্রীতে হয়ে ওঠে বেপোরোয়া, চলাচলে অগোছালো, সিদ্ধান্ত গ্রহনে চরম নির্ভরশীল, বিচার-বুদ্ধিতে ভীরু আর বিরক্তিকর আর বেশিরভাগ পুরুষই এসবকে ঘৃণা আর অবজ্ঞা করতে শেখে ছোটবেলা থেকেই। জীবনকে বয়ে নেয়ার জন্যে কি দারুণ সব অবস্থা, তাই না?
কিন্তু বিবাহ ছাড়া একজন শিশুকে কিভাবে সামাজিক ভাবে রক্ষা করা যাবে? মোটের উপরে এটাই কি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা নয়? কি বিপুল ভণ্ডামি, তাই না? বিয়ে প্রথা দিয়ে শিশুদের রক্ষা করার কথা বলছি অথচ দুনিয়া ব্যাপি লক্ষ লক্ষ শিশু রয়ে যাচ্ছে নাম পরিচয় বিহীন, আশ্রয়বিহীন। বিবাহ প্রথা দিয়ে আমরা সন্তানকে রক্ষা করার কথা বলছি আর অন্যদিকে এতিমখানা গুলো ভরে উঠছে অসহায় আশ্রয়হীন শিশুদের ভিড়ে। বিয়ে শিশুদের রক্ষা করে বলে দাবি করছি কিন্তু দিনের পর দিন শিশুদের উপরে বাবা-মা’য়ের নিষ্ঠুর আচরণের জন্যে শিশুদের কে আরও বেশি মানবিক ভালোবাসার পরিবেশ দিতে শিশু প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠান (‘জেরী সোসাইটি’) গুলো ব্যস্ত হয়ে উঠছে। কি অদ্ভুত প্রহসন ! তাই না?
হ্যাঁ, বিয়ে নামের প্রথাটির হয়তো এক ধরনের ক্ষমতা আছে দুটি ঘোড়াকে জলের কাছে নিয়ে যাওয়ার, কিন্তু তাদেরকে জল খাওয়ানোর ক্ষমতা কি আছে? কখনও পেরেছে? আইন হয়তো কোনো শিশুকে নির্যাতনের জন্যে তার পিতাকে জেলখানায় ভরতে পারে, শাস্তি দিতে পারে কিন্তু আইন কি শিশুর ক্ষুধার্ত থাকার অবসান করতে পেরেছে? যদি পিতামাতার কাজের কোনো সংস্থান না থাকে, কিংবা তারা যদি পরিচয় গোপন করে থাকে তাহলে বিয়ে প্রথা আসলে কি করতে পারে? রাষ্ট্র যখন কোনো পিতাকে শাস্তি দেয়, তাকে জেলখানায় নিয়ে যায়, সেখানে দেয়া তার শ্রমের ভাগ কিন্তু রাষ্ট্র পায়, তার সন্তানেরা নয়। শিশু যা পায় তা হচ্ছে ডোরাকাটা চেক ছাপার অপরাধির পোশাকে তার বাবাকে দেখার স্মৃতিটুকু।
আর নারীর প্রতিরক্ষার নামে বিয়ে হচ্ছে আসলে একটা অভিশাপের মতো। কে না জানেন, এটা আসলে নারীকে রক্ষা করে না, বরং এই যে প্রতিরক্ষার ধারনাটি সেটাই এতো বিতৃষ্ণাজনক, গা ঘিন-ঘিন করা, নিপীড়নমূলক ও অবমাননাকর যে, সেটা শুধু মানুষকে অবমাননাই করে না, বরং তার মানবিক মর্যাদাবোধকে ধ্বংস করে দেয়। সেজন্যেই এই পরজীবী প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ধিক্কার জারি রাখতেই হবে। এটা হচ্ছে আসলে পুঁজিবাদের মতোই আরেক ধরনের পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা। পুঁজিবাদ যেমন একদিকে মানুষের জন্মের অধিকারটিও কেড়ে নেয়, তাকে ক্ষুধার্ত রাখে, অপুষ্টিতে রাখে, তাকে দারিদ্র পীড়িত জীবনের মধ্যে দিয়ে ক্রমশই পরনির্ভশীল করে তোলে আর তারপরে তার জন্যে দানছত্র খুলে বসে নানান ধরনের চ্যারিটি প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে, যা আসলে শেষ পর্যন্ত মানুষের ভেতরে থাকা আত্মমর্যাদাবোধের শেষ অবশেষটুকুও ধ্বংস করে দেয়।
প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিবাহ আসলে নারীকে একটা পরজীবীতে পরিণত করে, আপাদমস্তক নির্ভরশীল বলতে যা বোঝায় আরকি। এটা নারীকে তার জীবন সংগ্রামের জন্যে অক্ষম করে তোলে, সমাজ সচেতনতা বলতে যা বোঝায় তার প্রায় সবকিছুই ধ্বংস করে দেয়, নিজের সৃজনশীলতাকে স্থবির করে করে দেয়, পঙ্গু করে দেয় আর এই সকল ধ্বংস গুলোকে মহিমান্বিত করা হয় প্রতিরক্ষা নামের একটা ধারণা দিয়ে যা মূলত একটা ফাঁদ আর মানব চরিত্রের হাস্যকর সব অনুকরণ।
যদি মাতৃত্বই হয় নারীর প্রাকৃতিক সত্ত্বার পরিপূর্ণতা, তাহলে তার প্রেম ও স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্যে আলাদা করে আর কি সুরক্ষা দরকার? বরং বিয়ে এক ধরনের নোংরামি ও নিপীড়নমূলক প্রথা যা আসলে নারীর পরিপূর্ণতার ধারনাটিকেই দূষিত করে তোলে। এটা কি নারীকে বলে না যে, তুমি তখনই জীবনদায়ী হয়ে ওঠো যখন তুমি এই প্রথাকে অনুসরণ করো? এটাকি নারীকে দোষী সাব্যস্ত করে না, প্রকাশ্যে ঘেন্না করে না যখন কোনো নারী নিজেকে বিক্রি করে মাতৃত্ব কিনতে চায়? যদিও এর মাঝে ভরা থাকে ঘৃণা ও বাধ্যবাধকতার জঞ্জাল, কেবল বিয়ে প্রথাটাই কি মাতৃত্বকে অনুমোদন করে না? আর মাতৃত্ব যদি হয় কেবল স্বাধীন ইচ্ছা, প্রেম ও গভীর আবেগ থেকে উৎসারিত, তাহলে বিয়ে নামের প্রথাটি কি সেই গভীর আবেগের নিস্পাপ সন্তানের মাথায় কাঁটার মুকুট পরিয়ে দেয় না? যে মুকুটে রক্তের অক্ষরে লেখা থাকে ‘জারজ’ নামের এক কুৎসিত বিশেষণ? বিয়ে প্রথাটি যে সকল গুণাবলী দাবি করে তা কি ছিলো এর মধ্যে? সত্যিকারের মাতৃত্বের বিরুদ্ধে বিয়ে প্রথাটির যে পাপাচার মূলক দুষ্কার্য সে কারণেই প্রেম ও ভালোবাসার দুনিয়া বিয়েকে চিরতরে খারিজ করে দেয়।
প্রেম হচ্ছে জীবনের সবচাইতে শক্তিমান ও গভীর নিদান, অগাধ আশাবাদ, আনন্দ, আবেগের উৎস। প্রেমই হচ্ছে সকল আইনের নির্ধারক, সকল প্রথা আর নিয়মের নির্ধারক, প্রেম হচ্ছে মানুষের নিয়তিকে গড়ে তোলার সবচাইতে স্বাধীন ও শক্তিমান ছাঁচ, এই রকমের একটি গভীর, সর্বব্যাপি, প্রেরণাদায়ী বিষয়কে কিনা তুলনা করা হচ্ছে, বিবাহ নামের রাষ্ট্র আর ধর্ম শাসিত একটা চরম ম্যাড়ম্যাড়ে আগাছার সাথে?
আর স্বাধীন প্রেম, সেটা কি বস্তু? এটা এমন যেনো প্রেম আর যাই হোক অন্তত স্বাধীন নয়। সারা দুনিয়াতেই মানুষ অপরের মস্তিস্ককে কিনতে পেরেছে কিন্তু প্রেমকে কিনতে পারেনি। মানুষ শারীরিক ভাবে মানুষকে দমন করেছে কিন্তু দুনিয়ার সকল শক্তিকে এক করেও সে প্রেমকে দমন করতে পারেনি। দেশে দেশে সেনাবাহিনীগুলো নানান ভূমি দখল করেছে, করতে পেরেছে কিন্তু মানুষের ভালোবাসা জয় করতে পারেনি। মানুষ তার আত্মাকে নানান ভাবে শৃঙ্খলিত করেছে, বন্দি করেছে কিন্তু কেবল প্রেমের বেলাতেই সে নিদারুণ অসহায়, নিঃস্ব। কোনো এক উচ্চ সিংহাসনে বসে, সকল মহিমা, গৌরব আর ধুমধাম আয়োজনের মধ্যে দিয়ে হয়তো শাসন করতে পারেন, হুকুমদারি করতে পারেন কিন্তু তারপরেও তার জীবনকে ঘিরে থাকতে পারে দারিদ্র আর উষরতা, কেবল প্রেম বিহনে। সেজন্যেই প্রেমের রয়েছে এক জাদুকরি ক্ষমতা, সে রাস্তার ফকির কে আমির বানিয়ে তুলতে পারে। হ্যাঁ, প্রেম স্বাধীন, এটা হাওয়ায় বাস করে না। স্বাধীন দুনিয়ায় প্রেম তার সবটুকু উজাড় করে দেয়, সে তার সকল প্রাচুর্য দিয়ে পূর্ণ করে দেয় মানুষ কে। প্রেম যখন শেকড় গাড়ে তখন দুনিয়ার কোনো কিছুই তাকে উপড়ে ফেলতে পারে না, রাষ্ট্রের সকল আইন, সকল আদালত সবকিছু মিলেও তার শেকড় ওপড়ানো সম্ভব হয় না। কিন্তু যে সম্পর্কের ভিত্তিভূমিটাই অনুর্বর, উষর যেখানে, সেখানে বিয়ে নামের প্রথাটি কিভাবে ফসল ফলাবে? এটা যেনো যমদূতের সাথে জীবনের শেষ টানাটানি লড়াইয়ের মতোই।
আসলে প্রেমের কোনো সুরক্ষার দরকার হয় না, কেননা প্রেম নিজেই নিজেকে সুরক্ষা দেয়। যখন প্রেম জীবনকে আলিঙ্গন করে, আমাদের জীবন যখন ভালোবাসায় স্নাত হয়, তখন কোনো সন্তানই অবহেলিত হয় না, ক্ষুধার্ত থাকে না কিংবা ভালোবাসা ও বাৎসল্যের কাঙাল হয়ে পড়ে থাকে না। আমি জানি এটাই সত্যি হবে। আমি এমন নারীদের জানি যারা স্বাধীন মা হয়েছেন সেই পুরুষদের সাথে যাদের তারা ভালোবাসেন, যাদের সাথে তাদের সম্পর্ক প্রেমের। বৈবাহিক দাম্পত্য খুব কম শিশুকেই যত্ন আর সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে, কিন্তু স্বাধীন মাতৃত্ব শিশুর এই সকল চাওয়াকেই পূরণ করার ক্ষমতা রাখে।
প্রথা আর কর্তৃপক্ষের সেবকেরা স্বাধীন মাতৃত্বকে ভয়ঙ্কর রকমের ভয় পায়, পাছে স্বাধীন মাতৃত্বের ধারণা তাদের শিকারকে তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়। তাহলে এই যে অসংখ্য যুদ্ধগুলো করবে কে? কে সম্পদ তৈরি করবে? পুলিশ বাহিনীতে কে যাবে? কারারক্ষী হবে কে যদি নারী যত্রতত্র যখন তখন সন্তান উৎপাদন কে না বলে দেয়? বংশ রক্ষা! বংশ রক্ষার দোহাই দিয়ে এক সুরে চিৎকার করে রাজা, রাষ্ট্রপতি, পুঁজিবাদী কিংবা পাদ্রীর দল। বংশ রক্ষা করতে হবে, সেটা নারীকে যন্ত্র বা পশু যা-ই বানানো হোকনা কেনো। আর নারীর শরীর জেগে ওঠাকে বৈধতা দানের একমাত্র পদ্ধতি-প্রতিষ্ঠান হচ্ছে বিবাহ নামের প্রথাটি। কিন্তু এই উম্মাদ প্রচেষ্টা তারপরেও ব্যর্থ। ধর্মের নেশাগ্রস্ততা, শাসকের উম্মাদ আক্রমণ এমন কি আইনের হাতও ব্যর্থ। নারী এখন আর শুধুই বংশ রক্ষার যন্ত্র হতে চায় না, নারী এখন আর অসুস্থ, দুর্বল, হিংস্র, নিষ্ঠুর মানুষের বংশধর উৎপাদনের পক্ষ হতে চায় না, যাদের দারিদ্র্য ও দাসত্বের জোয়াল নিক্ষেপ করার শক্তি বা নৈতিক সাহস কোনোটাই নেই। গণ্ডায় গণ্ডায় নয়, বরং এর বদলে সে চায় দুয়েকটি সন্তান, যাদেরকে সে পরম মমতায় স্বাধীন ভাবে বড় করে তুলতে পারে, যেখানে কোনো বাধ্যবাধকতা থাকে না বৈবাহিক সম্পর্কের মতো। সন্তানের প্রতি গভীর দায়িত্ববোধ কি সেটা আমাদের ভণ্ড নীতিবাগিশদের এখনও এটা শিখতে হবে, যেখানে স্বাধীন ভালোবাসা জেগে ওঠে মাতৃস্তন্যের মাঝে। একটা বিষাক্ত, ধ্বংসাত্মক পরিবেশের মধ্যে নতুন জীবনের জন্ম না দিয়ে নারী বরং কথিত মাতৃত্বের গৌরব সারাজীবনের জন্যে ত্যাগ করবে । আর যদি সন্তানের মা হতেই হয় তাহলে নারী তার সন্তানকে জীবনের সবচাইতে শ্রেষ্ঠ অর্জনের সবকিছু দিয়ে বড় করে তুলবে। সন্তানের সাথে নিজেও বড় হয়ে ওঠাটা হয় তার লক্ষ্য, সে জানে এই একাকী যাত্রায় কিভাবে মনুষ্যত্ব ও মাতৃত্ব উভয়কে গড়ে তুলতে হয়।
ইবসেন যখন তার কুশলী তুলিতে মিসেস আলভিং কে আঁকেন, তখন নিশ্চয়ই তার একটা লক্ষ্য ছিলো একজন স্বাধীন মায়ের ছবি আঁকার। মিসেস আলভিং ছিলেন একজন আদর্শ মা কেননা তিনি বিয়ে প্রথা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন, অতিক্রম করতে পেরেছিলেন এর সকল ভয়াবহতাকে, কারণ তিনি তার নিজের শেকল ছিন্ন করতে পেরেছিলেন এবং তিনি তার আত্মাকে স্বাধীনভাবে ছেড়ে দিতে পেরেছিলেন যতক্ষণ না তা নিজেই একটা ব্যক্তিত্ব অর্জন করে, যা পুনরুত্থিত এবং বহুগুণে শক্তিমান। কিন্তু হায়, ততদিনে বহু জল গড়িয়ে গেছে, হয়তো আর নিজের জীবনের হারিয়ে যাওয়া আনন্দ হর্ষগুলোকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না, কিন্তু এইটুকু অন্তত অনুভব করা যাবে যে, জীবন সবচাইতে সুন্দর হয়ে ওঠে প্রেম ও ভালোবাসার স্বাধীনতায়। যারা ইবসেনের নাটকের মিসেস আলভিং এর মতো নিজের রক্ত আর অশ্রু দিয়ে জীবনকে খুঁজে নিয়েছেন, তারাই বিয়ের মতো একটা চাপিয়ে দেয়া, অগভীর, ফাঁপা পরিহাসকে অস্বীকার করতে পেরেছেন। তারা জানেন প্রেম ও ভালোবাসার সম্পর্ক যত সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যেই হোক কিংবা চিরকালের তরেই হোক, প্রেমই মনুষ্য সভ্যতার সবচাইতে সৃজনশীল, প্রেরণাদায়ী, অগ্রসর প্রজন্মের ভিত্তি, একটা নতুন বিশ্বের নিশ্চয়তা।
আমাদের কালের এই বামন সমাজে বেশিরভাগ মানুষের কাছেই প্রেম হচ্ছে একটা ভিনগ্রহের বিষয়। বেশিরভাগ সময়েই দারুণ ভাবে ভুল বোঝাপড়ার উপরে দাঁড়ানো অথবা দূরের বিষয় হয়ে থাকে, প্রেম আমাদের জীবনে শেকড় গাড়তে পারাটা বিরল ঘটনা, যদিও বা কখনও বা শেকড় গাড়তে পারে, দ্রুতই শুকিয়ে যায় অথবা তার মৃত্যু ঘটে। আমাদের দৈনন্দিন যাপিত জীবনের যে রূক্ষতা, ভাঙ্গা-গড়া তার ভারে প্রেমের সূক্ষ্ম তন্তু খুব বেশিক্ষণ অক্ষত থাকে না। আমাদের সমাজের যে নোংরা কর্দমাক্ত বুনন তার সাথে প্রেমের সম্পর্কের মানিয়ে নেয়াটা যথেষ্টই জটিল। প্রেম তাই আমাদের সমাজে শুধু কাঁদে, গোপনে ডুকরে কাঁদে আর ভোগান্তি বয়ে আনে যাদের তার দরকার, কিন্তু তার পরেও আমরা ব্যর্থ হই প্রেমের সম্পর্ককের উত্থান ঘটাতে।
একদিন হয়তো নারী ও পুরুষ দুজনেই জেগে উঠবেন, তারা হয়তো পাহাড়সম উচ্চতা অর্জন করবেন, তারা পাহাড়ের মতোই বিশালত্ব নিয়ে, শক্তি নিয়ে স্বাধীন ভাবে মিলিত হবেন, প্রেমের– ভালোবাসার সোনালী আভা নিয়ে পরস্পরের সাথে মিলিত হবেন, প্রেম পেতে, প্রেম দিতে। অভিনবত্ব, সৃজনশীলতা আর কাব্যময়তা দেখতে পায় নর ও নারীর জীবনের সম্ভাবনা আর জীবনী শক্তিকে। যদি আমাদের পৃথিবী কখনও মানুষের সত্যিকারের সম্পর্কের জন্ম দিতে পারে, অভেদ সত্ত্বার জন্ম দিতে পারে, সেদিন বিয়ে নয় প্রেমই হবে সেই অনাগত শিশুর পিতা-মাতা।